Wednesday, May 14, 2014

শকুনি মামার জর্নালঃ কিস্তি ১

আমার বয়েস ২৪। এ বয়েসের কিংবা এ বয়েসের আশেপাশের কাউকে যদি "নিজেকে বর্ননা করে" এমন ক'টি শব্দ নির্বাচন করতে বলা হয়, অনেকেই হয়ত "দুর্বল", "ঊন", "হেরে যাওয়া মানুষ" ইত্যাদি শব্দাদি বেছে নেবেন। "ঊন" হওয়া কিংবা হেরে যাওয়াটা তো খুব ভালো কিছু নয়; বস্তুত কেউই এই দলে থাকতে চাননা, এবং সুযোগ পেলেই নিজের তুলনায় আপেক্ষিক ভাবে যিনি "ঊন" তাঁকে হেয় করতে চান ( তা না হলে কী আর লোকে এমনি এমনি তার স্কুল/ কলেজ/ ইউনিভার্সিটির ভুল ইংরেজী বলা মাষ্টারকে আড়ালে ভেংচি কাটে? কিংবা, অপরের কালো চামড়া, হলদে দাঁত, অসুন্দর মুখ, গায়ের বোঁটকা ঘেমো গন্ধ ইত্যাদি "ঊন" গুণবাচক দিকগুলো নিয়ে টিটকারি মারে?) । কিন্তু তবুও মানুষ "ঊন" হতে পারার রোমান্টিকতাকে এড়িয়ে যেতে চায় না। নিজের বর্ননায় মানুষ অহরহ "আমি একজন ঊনমানুষ বলছি" কিংবা "হেরে যাওয়া যুবকের গল্প শোনাচ্ছি" জাতীয় "ফ্রেইজ" ব্যবহার করেন। ঊন শব্দের আভিধানিক অর্থ দুর্বল কিংবা কম। ঊনপঞ্চাশ শব্দের অর্থ দাঁড়ায় তাহলে পঞ্চাশ থেকে "দুর্বল"। বাংলা ভাষার প্রায়োগিক দিকের সৌন্দর্যগুলো অসীম। আফসোস, এই সৌন্দর্যগুলো শুধু আমরা যারা বাংলা ভাষাভাষী, তারাই বুঝতে পারবো। ভিনদেশী বুলির কেউ এই ব্যাপারগুলো কখনো জানবেইনা। অবশ্য, পৃথিবীর সব ভাষারই নিশ্চয় এমন সৌন্দর্য আছে, যা শুধু ওই ভাষাগুলোর মানুষেরাই দেখতে পাবে। সৌন্দর্য বোধহয় সবার জন্য নয়। যে সৌন্দর্য সবাই আবিষ্কার করে ফেলে, তা আর সুন্দর থাকেনা। যে পার্কের টিকিটের দাম যত বেশী, সে পার্ক ততো বেশী পরিচ্ছন্ন। যে পার্কে প্রবেশের জন্য কোন টিকিটই নেই, সে পার্কে বাদামের খোসা, চিপসের প্যাকেট, দেশলাই এর কাঠি, সিগারেট এর বাট, ব্যবহৃত ছেঁড়া রাবার, কফ-থুথু ইত্যাদি পার্কের জমির যেখানে সেখানে মানচিত্র আকারে উপস্থিত থেকে নিজেদের স্বাধিকার ও সার্বভৌমত্যের কথা সগর্বে জানিয়ে দেয়।

সৌন্দর্য প্রসঙ্গ বরং থাকুক। ঊন এর কথা তেই ফিরে যাই। বিশেষতঃ তরুণ কালে মানুষ নিজেকে দূর্বল ভাবতে ভালোবাসে।  তরুণকালের গান কিংবা কবিতার কথাগুলোতে ঘুরে ফিরে আসে "আমি এক বিভ্রান্ত পথিক"। ছোটবেলা পেছনে ফেলে বড়বেলায় শেয়ানা হবার কালে এসে আবিষ্কার করলাম চারপাশে আমার বয়েসী তরুনেরা প্রায় সকলেই "দুর্বল", "অচ্ছুৎ", "বিভ্রান্ত" এবং "অকিঞ্চিৎকর", অন্তত বাহ্যিক ভাবে, তাঁদের নিজেদের বর্ননায়। ভেতরে কে কতটুকু শক্তি ধরেন তা বাহ্যিক এই পরিচয় দিয়ে নির্নয় করা যায় না। মানুষ তো নিজে দুর্বল হতে চায় না, তবুও কেন নিজেকে দুর্বল হিসেবে জাহির করবার এই অক্লান্ত প্রয়াস? এ কী স্রেফ বিনয়? বিশ্বাস হতে চায় না। মানুষ স্বভাবগত ভাবে বিনয়ী প্রানী নয়। বাহ্যিক ভাবে একজন মানুষ পরিপার্শ্ব‍ের কাছে নিজেকে যতটা অকিঞ্চিৎকর ভাবান, তিনি নিজেও যদি নিজেকে ততটুকুই অকিঞ্চিৎকর ভাবতেন, তাহলে বোধহয় সমাজে মারপিট ব্যাপারটাই উঠে যেত। কারণ, সবাই বিনয়ী, কেউ নিজের মতের প্রতিষ্ঠার জন্য অপরের গালে চড় মেরে বসতেননা! সৃষ্টিকর্তা যদি থেকেই থাকেন, তাহলে তাঁকে কতগুলো পুস্তক লিখতে হয়েছে বারে বারে, স্রেফ মানুষকে বিনয়ী বানাবার জন্য! যদি ধর্মপুস্তক মনুষ্য লিখিতও  হয়ে থাকে, তাহলেও তার মানে দাঁড়াচ্ছে প্রত্যেক কালেই কিছু মানুষ চেয়েছেন সকলেই বিনয়ী হোক, অর্থাৎ সকলেই নিজেকে সত্যিকার ভাবেই ঊনমানুষ ভাবুক। পৃথিবীর বেশীর ভাগ মানুষই যে আসলে সত্যি কথা বলেননা, বা চারিত্রিকভাবে অপরাধপ্রবণ তা আইনজীবীদের চেম্বারে গেলে বেশ বোঝা যায়! আইনজীবীদের বুকশেলফ ভর্তি অসম্ভব স্বাস্থ্যবান সব বই থাকে, যে বইগুলোর উদ্দেশ্যই
হচ্ছে আত্নপক্ষ সমর্থনে মানুষ যতরকম মিথ্যে কথা উদ্ভাবন করতে পারে, তার সবগুলোর রাস্তাই বন্ধ করে দেয়া। আইন-কানুন আমার কাছে অত্যন্ত ঘোরালো একটি বিষয়। কোন দেশের আইন খুব কড়া মানে সে দেশের আইনের চোখে দেশবাসী অত্যন্ত উগ্র। তাদের নিয়মের মাঝে বেঁধে রাখতে খুব শক্ত রজ্জু দরকার। শক্ত আইন আর শক্ত রজ্জুর মাঝে তফাৎ বেশী দেখিনা। একই ভাবে, কোন প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্র যখন দাবী করে, তার নিরাপত্তা ব্যবস্থাই সর্বশ্রেষ্ঠ, প্রতীয়মান হয়, সে প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্র তার কর্মচারী কী অধিবাসীকে মোটেই বিশ্বাস করেনা। মনে হয়, তাদের গলায় সর্বদা খুব স্পর্শকাতর ঘন্টি ঝোলানো থাকে। স্বাভাবিকের চেয়ে একটু জোরে নিঃশ্বাস ফেললেই মাথার হালকা ঝাঁকুনিতে ঘন্টি বেজে উঠবে গগণবিদারী আওয়াজে। সারকথা, মানুষই মানুষকে বিশ্বাস করেনা, এবং যে যত অবিশ্বাস করে, অর্থাৎ যার 'নিরাপত্তা ব্যবস্থা' যত জোরদার, তাঁর তত বাহবা প্রাপ্তি। 

পৃথিবীব্যাপী নিশ্চয়ই হাজার হাজার আইন প্রণেতা আছেন। অপরাধপ্রবণ দূরাচারী মনে প্রশ্ন আসে, আইন প্রণেতারা সকলেই কি সবসময় সত্য কথা বলেন? মিথ্যাচার, লোভ, কাম, আসক্তি ইত্যাদি সব "ঊন" বৈশিষ্ট্য'রই উর্দ্ধে তাঁরা? 

মানবসমাজের বেশীরভাগ অংশটাই মিথ্যে কথা বলে, ভান করে, অপরাধ করে। তাই হয়ত বেশীরভাগ অংশটাই নিজেদের ঊনমানুষ ভাবে। ঊন হবার "রোমাঞ্চ"কে অস্বীকার করব, অতখানি ঊন ও নই। মন্দ লোক পরিচয়বাহী পৈতা ধারণ করতে হয়,  তাই বাগধারার বইয়ের কূটবুদ্ধিদাতা মন্দ লোক শকুনি মামা'ই হলাম।  বুদ্ধি আমার অল্পই, নিজেরই চলেনা, তাই অপরকে ধার দেবো সে প্রশ্নও আসেনা (হোক না সে যতই কূটবুদ্ধি!)। আক্ষরিক অর্থে কূটবুদ্ধিদাতা শকুনি মামা না হলাম, অন্তত আমার বালক ভাগিনেয়দ্বয়ের চোখে তো আমি শকুনি মামা বটেই। তাদের খেলায় আমি অংশ নেই না, আমার খেলায় তাদের অংশ দেইনা। প্রত্যাখ্যাত তাদের দৃষ্টিতে জিঘাংসা, হতাশা আর অসহায়ের দুঃখ দেখতে পাই তখন। জীবনটা এভাবেই চলছে। কখনো কাউকে বঞ্চিত করে নিজে শকুনি মামা হই, কখনো অন্যের প্রবঞ্চনায় ঠকে গিয়ে কষ্ট ঝাড়বার একমাত্র উপায় হিসেবে প্রবঞ্চককে শকুনি মামা গাল পাড়ি। এ জর্নাল, অতএব, জগতজোড়া আবহমান কাল থেকে শাসন করে আসা শকুনি মামাদের প্রতিই উৎসর্গীকৃত হোক। (চলিবেক)